বাংলাদেশের কোরবানির ঈদ: ইতিহাস, বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আয়না
বাংলাদেশে ঈদ উল আযহা মানেই শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি আমাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বাস্তবতার এক জ্যান্ত প্রতিফলন। তবে ঈদ উল ফিতরের তুলনায় কোরবানির ঈদ এখনও তুলনামূলকভাবে সীমিত পরিসরে পালিত হয়। কেন এই পার্থক্য? কীভাবে ইতিহাস, সমাজ ও অর্থনীতি এ উৎসবকে প্রভাবিত করেছে? চলুন ইতিহাস ও বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করি আমাদের কোরবানির ঈদের রূপান্তর।
ছবি: কালেক্টেড
কোরবানির ঈদের শিকড়: বাংলার ইতিহাসে ধর্মচর্চার স্থান
বাংলার মাটিতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে মূলত ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের পর। তবে এর বাস্তব চর্চা শুরু হয় বহু পরে। ফরায়েজি আন্দোলনের মতো ধর্মীয় পুনর্জাগরণ না আসা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জীবনে কোরবানি, নামাজ বা রোজার মতো বিষয়গুলো প্রবেশই করতে পারেনি।
তখনকার অধিকাংশ মুসলমানই ছিল হিন্দু শূদ্র সম্প্রদায় থেকে ধর্মান্তরিত দরিদ্র মানুষ, যাদের জন্য একটি গরু কোরবানি দেওয়া ছিল অকল্পনীয়। জমি-জিরাত, সম্পদ—সবই ছিল উচ্চবর্ণ হিন্দুদের হাতে। ফলে ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করা ছিল অনেকটাই এলিটদের ব্যাপার।
ধর্মীয় চর্চা থেকে সাংস্কৃতিক চর্চায় রূপান্তর
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলমানরা কিছুটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও ধর্মচর্চা ও কোরবানি তখনও সীমিত ছিল। শহরাঞ্চলে ধনীদের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল।
এরপর ১৯৯০ সাল থেকে দেশে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। তারা ইসলামের দিকেও ঝুঁকে পড়ে, যার প্রভাব পড়ে কোরবানির ঈদ উদযাপনেও। তবে এই পরিবর্তন ধাপে ধাপে হয় এবং গ্রামাঞ্চলে এর প্রতিফলন আসে অনেক পরে।
অর্থনীতির বাস্তবতা: কোরবানির সক্ষমতা কার?
২০১৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরণের চাপ দেখা যায়। করোনা মহামারী এই চাপকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বহু মধ্যবিত্ত পরিবার নিম্নবিত্তে নেমে আসে। কোরবানির জন্য গরু কেনা হয়ে পড়ে বিলাসিতা। গরুর মাংস হয়ে ওঠে অভিজাতদের পণ্য।
আগে এক গরুতে পাঁচ-সাতজন ভাগ করে কোরবানি দিতেন। এখন কেউই কোরবানি দিতে রাজি নন, যদি পুরোটা মাংস নিজের বাসায় না থাকে। একপাশে ডিপ ফ্রিজ ভর্তি করে রাখা হয়, অন্যপাশে দিনমজুর বছরের পর বছর মাংসের স্বাদও পান না।
ধর্মীয় বিতর্ক: মাংস তিন ভাগ না এক ভাগ?
২০২২ সালে এক জনপ্রিয় ইসলামিক বক্তার বক্তব্য ভাইরাল হয়, যেখানে বলা হয় যে কোরবানির মাংস তিন ভাগ করার নির্দিষ্ট দলিল নেই। এ বক্তব্য সমাজে আলোড়ন তোলে। ফলে অনেকেই দান করার প্রবণতা থেকে সরে আসেন।
এর ফল দাঁড়ায়—বাড়ির গ্যারেজে বা ঘরের ভেতর কোরবানি, দরজা বন্ধ করে রান্না, আত্মীয়-স্বজন বা দরিদ্রদের কাছে মাংস না পাঠানো। এটি ইসলামের উদ্দেশ্য বা সামাজিক সংহতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
রান্নার ধরণ ও উপস্থাপন: আমাদের একঘেয়ে ঐতিহ্য
বাংলাদেশে গরুর মাংস রান্না প্রায় একটাই পদ্ধতিতে হয়—সব অংশ টুকরো করে একসাথে রান্না করা, অধিক তেল-মশলায় চাপা দেওয়া। ফলে মাংসের স্বাদ ও বৈচিত্র্য হারিয়ে যায়।
আধুনিক কিচেন, রন্ধন শিক্ষা ও গরুর বিভিন্ন অংশ অনুযায়ী রেসিপি আমাদের দেশে এখনো ব্যাপক হয়নি। কোরবানির দিন এলেই কেবল হাড়, মাংস ও গন্ধের অতিরিক্ত ভিড়!
কোরবানির ভবিষ্যৎ: কীভাবে বদলাতে পারি?
-
সচেতনতা: ঈদ মানেই শুধু নিজের আনন্দ নয়, বরং আশেপাশের মানুষদেরও অংশীদার করা।
-
ভাগাভাগি: ডিপ ফ্রিজে না রেখে অন্তত আশেপাশের দরিদ্র মানুষ, কর্মজীবীদের মধ্যে কিছু মাংস বিলি করাই ইসলামের মূল শিক্ষা।
-
সম্পর্ক রক্ষা: আত্মীয়তার বন্ধন, পাড়া-প্রতিবেশীর খোঁজ—এসবই একদিন ছিল কোরবানির ঈদের মূল সৌন্দর্য।
-
অর্থনৈতিক ভারসাম্য: গরু না কিনে শেয়ার কোরবানির সংস্কৃতি ফেরানো দরকার। এতে একদিকে যেমন খরচ বাঁচবে, অন্যদিকে দানও সহজ হবে।
পরিষেশে বলা যায় যে,
বাংলাদেশের কোরবানির ঈদ এক সময় ছিল সীমিত, তারপর বিস্তার ঘটেছে, আর এখন ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে—ধর্মীয় চর্চা থেকে অর্থনৈতিক বাস্তবতা, সাংস্কৃতিক সংকোচন থেকে বৈষম্য, সব মিলিয়ে এটি একটি সামাজিক আয়না।
এই উৎসব যদি আবার সহানুভূতি ও সংহতির হয়ে ওঠে, তাহলেই ঈদের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হবে। মাংস নয়, ভালোবাসা হোক ভাগাভাগির মুখ্য উপাদান।